১৪৯২-এ কলম্বাসের প্রথম অভিযান থেকেই মহামারি এবং বাণিজ্যিক পুঁজির ইওরোপীয় উৎসের শক্তিগুলি আমেরিকার ভূখণ্ডের মূল অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করেছিল অভাবনীয় বর্ববতায়। এইভাবেই সংগঠিত হয়েছিল আমেরিকার প্রাচীন আদিবাসীদের সমগ্র জনসংখ্যাকে নির্মূল করার কাজ। এই দুই মহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নিদারুণ ফলাফল দেখেই চার্লস ডারউইন মন্তব্য করেছিলেন : ইওরোপীয়ানরা যেখানেই গেছে সেখানেই ভূখণ্ডের প্রকৃত অধিবাসীদের নির্মূল করা হয়েছে ভয়াবহ নৃশংসতায়।
১৯৪২-এর পর এক শতাব্দীর মধ্যে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ান জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিলো ৯০শতাংশ। প্রান্তিক দেশগুলির অগ্রগতির সমস্ত প্রয়াস ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে চূড়ান্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যার মধ্য দিয়ে নিজস্ব অর্থনীতি অগ্রগতির পরিবর্তে, দরিদ্র, প্রান্তিক অর্থনীতির সম্পদ নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়েছিল কেন্দ্র বা উন্নত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির ভাণ্ডার।
পরিবেশের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করে এই বিশ্বের অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে। প্রকৃতিকে গণ্য করেছে অফুরান সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে। তাকে নিংড়ে, বিশৃঙ্খল, অবিন্যস্ত করে নিজেকে স্ফীত করেছে সম্পদের প্রাচুর্যে। আর সেই সম্পদ উৎপাদনের গতিপথে জমে ওঠা বর্জ্য পদার্থ ফেলার ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করেছে পৃথিবীকে। একটা সময় পর্যন্ত প্রকৃতির এই একপেশে লুন্ঠন আঞ্চলিক পরিবেশএ সর্বনাশা নিঃস্বতা নিয়ে এসেছিল। ক্রমান্বয়ে সমগ্র সভ্যতাই শেষ হয়েছিল এই লুন্ঠন আর ধ্বংসের চক্রাকার অনুবর্তনে।
আসলে পরিবেশের সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটায় মুনাফাই। মুনাফার জন্য যা করা দরকার, তাই করতে পারে যে অর্থনীতি, মুনাফা-তৃষিত সেই অর্থনীতির পক্ষে দাঁড়ায় যে রাজনীতি, মুনাফার মধ্যে জীবন খুঁজে পায় যে চোখ ধাঁধানো জীবনধারা, সেটাই পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। সেই অর্থনীতি, সেই রাজনীতি, সেই জীবনধারা নিজ স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু, অন্য কারো কথা ভাবে না, বিবেচনা করে না। এ পৃথিবী, প্রকৃতি, প্রাণ, সবই তার কাছে বিবেচনা বহির্ভূত বিষয়। এ আসমান-জমিনই কেবল নয়, মহাকাশ, মহাসমুদ্রতল, ভূগর্ভ, রোদ, বাতাস, সবই সে অর্থনীতির, সে রাজনীতির, সে জীবন ধারার কাছে হয়ে ওঠে মুনাফার মাধ্যম, মুনাফার উপকরণ। মুনাফার অন্বেষা, মুনাফার তৃষ্ণার কাছে দূষণ, প্রাণ ধারণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচিত হয় না।
অথচ, পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রথম দিকে বলা হয়েছিল : দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটায়। আর সেই যুক্তিই দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দুনিয়ার সর্বত্র। প্রকৃত বিশ্লেষণেও বিষয়টি তাই। মুনাফা তৈরি করে দারিদ্র্যকে। কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের জীবনে আটকে রেখে, তাদের বাড়তি মেহনত আত্মসাৎ করে তৈরি হয় মুনাফা। আর তৈরি হয় তারই উপজাত দারিদ্র্য।
দারিদ্র্যের বন্দিশালায় প্রজন্ম পরম্পরায় আটকে থাকা অগণিত মানুষ স্রেফ টিকে থাকার জন্য মাটি থেকে, ধুলো থেকে, কাদা থেকে, ইঁদুরের গর্ত থেকে, আর্বজনার স্তূপ থেকে, ধান গাছের শেষাংশ থেকে, ঝরাপাতা থেকে, ঝিনুক থেকে, গাছের শেষ শেকড়টুকু থেকে, ফেলে দেওয়া খাবারের শেষ থেকে, প্লাস্টিক বোতল বা কাগজের গ্লাস থেকে সংগ্রহ করেন নানা উপাদান। ময়লা কাগজের টুকরোগুলো, ভাঙা বিদ্যুৎ সুইচ, ভাঙা কলম, ভাঙা তালা, ছেঁড়া ময়লা ন্যাকড়া, এমন অসংখ্য সামগ্রী হয়ে ওঠে তাদের একটু বেঁচে থাকার উপায়। মুনাফা-দানবের জয় করে নেওয়া এ পৃথিবীতে এসবই এত নগণ্য যে, সে সব আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। গরিবরা এভাবে ‘অবদান’ রাখেন পরিবেশ রক্ষায়, নানা সামগ্রী বারবার ব্যবহার করে, অপচয় রোধ করে। মুনাফা আর দারিদ্র্যের নির্মম হাত তাদের ঠেলে দেয় এই কর্তব্যের কারখানায়। তাদের জীবন পিপাসা ধনীদের পরিতক্ত্য প্রতি বিন্দু বারি, প্রতি টুকরো কাগজ, প্রতি টুকরো কাঠ, প্রতি পাতা ব্যবহারে বাধ্য করে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এতে প্রকৃতির ক্ষতি হয়। বন থেকে, পথের ধারের গাছতলা থেকে সব পাতা কুড়িয়ে নিলে, ধান ক্ষেতে শেষ নাড়াটুকু তুলে নিলে জমি বঞ্চিত হয় খোরাক থেকে। কিন্তু সে তো গরিবের শখের কাজ নয়। তা গরিবের বেঁচে থাকার অবলম্বন। গরিবদের সে জীবনে ঠেলে না দিলেই হয়, যেখানে গরিবকে চেঁচে-পুঁছে-খুঁড়ে-খাবলে-ঝেটিয়ে-কেটে সব নিতে হয় না, যেখানে তেল মাখা ময়লা কাপড় উনুনে পুড়িয়ে ভাত রান্না আর বায়ুদূষণ ঘটাতে হয় না, যেখানে অপরিপক্ক পোনা মাছ ধরতে হয় না, যেখানে করতে হয় না বনের ডালপালা চুরি।
কিন্তু, এত সব করে গরিবরা ভোগ করেন কতটুকু? তারা সারাজীবনে কয়টি কাগজের তৈরি গ্লাস, কয়টি কাগজের তৈরি ন্যাপকিন, কয়টি হ্যামবার্গার, ক’বোতল ঠান্ডা পানীয় সাবাড় করেন? তারা কতো মাইল পথ সারাজীবনে আকাশপথে পাড়ি দেন? বিদ্যুৎ, অন্যান্য জ্বালানি, জল তারা কতোটুকু খরচ করেন?
আর আমাদের এই সম্পদ সীমাবদ্ধ জগতে ধনীরা, অতি ধনীরা কি করেন? তাদের কয়েকশো কোটি টাকা দামের বাড়ি, নিজস্ব জেট বিমান, নিজস্ব দ্বীপ, অপচয় আর উচ্ছিষ্ট ছড়ানো প্রমোদ অনুষ্ঠান, দামি গাড়ির বহর, কল্পনা ছাড়িয়ে যাওয়া দামের পোশাক, আর বাহারি খাওয়া, সুরক্ষিত সাজানো বসত এলাকা, বিলাস করা বিনোদনের বিস্তৃত অশ্লীল আয়োজন। এদেরই বিলাসের জন্য এ পৃথিবীর কত গাছ, কত আবাদি জমি, কত বাতাস, কত জল নষ্ট হয়, দূষিত হয়! পৃথিবীর প্রায় ৭৬ভাগ সম্পদ ভোগ করে ধনীরাই, সমাজের মাথায় বসে থাকা মাত্র ২০ভাগ মানুষ। অথচ এরা তৈরি করে না সম্পদ। এরা তৈরি করে পরিবেশ দূষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য। প্রাণের টিকে থাকার জায়গাটুকুতে এরা এঁকে দেয় ধ্বংসের চিহ্ন। ভাবুন, পৃথিবীতে মোট ভোগের ০.৫শতাংশ পেতেন একেবারে গরিব ১০শতাংশ মানুষ, আর ৪৯শতাংশ যায় সবচেয়ে ধনী ১০শতাংশ লোকের পেটে। যদিও খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেওয়া এই হিসাব ছয় বছর আগের। আজ বৈষম্য বা ফারাক আরো বেড়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচির আরো আগের আরেকটি হিসাব থেকে দেখা যায় : সবচেয়ে ধনী ৫ভাগ লোক ভোগ করতো পৃথিবীর সব মাছ-মাংসের ৪৫ভাগ, মোট ইন্ধনের ৫৮ভাগ, মোট টেলিফোন লাইনের ৭৪ভাগ, মোট কাগজের ৮৪ভাগ, মোট গাড়ির ৮৭ভাগ।
তাকিয়ে দেখুন এই ভারতের দিকে। যেখানে কালো টাকা নিয়ে কতো গোপনীয়তা। শুধু সুইস ব্যাঙ্ক নয়, গত ছ’দশকে এই ভারত থেকে বিদেশে পাচার হওয়া কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬,২০০কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা ২০লক্ষ ৩২হাজার ৮০০কোটি। এই অর্থ ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) অন্তত ৪০শতাংশ। আর এই সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ভারতের মোট কালো টাকার পরিমাণ প্রায় ১,৫০,০০০কোটি ডলার। ৭০লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। অথচ, একবার এই অর্থ ফিরিয়ে আনলে, তাবৎ বৈদেশিক ঋণ মিটিয়ে দেওয়া যাবে এক চব্বিশ ঘন্টায়। এই অর্থ যাদের ঘামরক্ত শুষে তৈরি হয়েছে, তা যদি দেশে ফিরিয়ে এনে সেই ৪৫কোটি গরিব মানুষের প্রত্যেককে ১,০০,০০০টাকা করে দেওয়া যায়, তাহলেও উদ্বৃত্ত থাকবে ২৫লক্ষ কোটি টাকা। এনিয়ে সরকারকে ভৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বোধদয় হয়নি সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, এটি না কী চটজলদি সমাধানের কাজ নয়।
কর ফাঁকি দিতে বহু বেসরকারী সংস্থা এবং ধনী ভারতীয়ই বিদেশে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে অর্থ জমা রেখে চলেছেন। সরকারী ত্রাণে আসলে মুনাফার পাহাড় বানাচ্ছে ধনীরা? ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি গোষ্ঠীর বরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেব করের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত ফিবছর গড়ে ২২০০-২৭০০কোটি ডলার বিদেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে পাচার হয়েছে। মুদ্রার বর্তমান বিনিময় মূল্য ধরলে কম করে ১,১০,০০০কোটি টাকা। যদি এর চারভাগের একভাগও কর হিসেবে উদ্ধার করা যেত, তাহলে ফিবছর গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে অর্থ সাহায্য করে হাঁটা যেত দীর্ঘ পথ।
অথচ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮২টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৪। ভুটানও আমাদের ওপরে। আমাদের দারিদ্র্যের সংজ্ঞাটাই আসলে সবচেয়ে বড় প্রহসন! শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিকাশীকে হিসেবের মধ্যে না রেখেই আমাদের দারিদ্র্যের সংজ্ঞা। বাড়ছে ক্ষুধা, কমছে মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ। বাড়ছে বেকারী, মাইগ্রেশন। গরিবের সংখ্যা কমাতে বি পি এলের সংজ্ঞা নির্ধারণে চলছে নির্লজ্জ টালবাহানা।
ভাবুন একবার, দেশের বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমের অবিরত প্রচারে আপনার মস্তিষ্কে কতো সহজে গেঁথে দিয়েছে একটাই কথা : আম-আদমির ভারত!
ভারতের সংবাদ জগতে এমন তীব্র সম্মিলিত উল্লাস এর আগে কখনো দেখা যায় নি। দেশের সুগভীর বিপন্নতায় কী স্পর্ধিত ঔদাসিন্য। সামান্যতম প্রতিফলন নেই সর্বনাশা বাস্তবতার! নেই সতর্কতার একটি অক্ষরও! কী পরিকল্পিত বিচ্ছিন্নতায় স্বনির্বাসিত দেশের গণ-মাধ্যম।
সম্প্রতি ‘কাউন্টার কারেন্ট’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফারুক চৌধুরীর এক প্রবন্ধে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো হিসাব আরো আছে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রসাধনী সামগ্রীর পেছনে বছরে ব্যয় হয়েছে ৮০০কোটি ডলার। ইউরোপে আইসক্রিমের পেছনে খরচ হয়েছে ১১০০কোটি ডলার। ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুগন্ধীর পেছনে ঢালা হয়েছে ১২০০কোটি ডলার। এ দুই মহাদেশে পোষা জীবজন্তুর জন্য ব্যয় হয়েছে ১৭০০কোটি ডলার। জাপানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সময় বিনোদনে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৫০০কোটি ডলার। ইউরোপে সিগারেটের পেছনে উড়ে গেছে পাঁচ হাজার কোটি ডলার, অ্যালকোহলের জন্য ঢালা হয়েছে গড়ে ১০হাজার কোটি ডলার। সামরিক খাতে বিশ্বে ব্যয়? লক্ষ-কোটি ডলার।
আর গোটা দুনিয়ায় সবার জন্য শিক্ষায় খরচ ৬০০কোটি ডলার, সবার জন্য নিরাপদ জলের ব্যবস্থা করতে খরচ ৯০০কোটি ডলার, মৌলিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য ১৩০০কোটি ডলার, সব মহিলার স্বাস্থ্যের জন্য ১২০০কোটি ডলারের ব্যবস্থা হলেই চলত। এ তথ্য দিচ্ছে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেই রয়েছে।
এ সব তথ্যের পরে তাই আর ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না যে, দূষণ কারা, কতোটুকু ঘটায়, কোন ব্যবস্থায় ঘটে। এ ব্যবস্থাটি টিকে থাকবে কিনা, টিকিয়ে রাখা দরকার কিনা সে প্রশ্নগুলো এসে পড়ে। ফ্রান্সের লা মঁদে পত্রিকার পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হার্ভে ক্যাম্প ‘হাউ দ্য রিচ আর ডেস্ট্রয়িং দ্য আর্থ’ (ধনীরা কিভাবে পৃথিবীকে ধ্বংস করছে) বইতে বলেছেন, বর্তমান ব্যবস্থা যা মানব সমাজকে এখন চালাচ্ছে, সেই ব্যবস্থা অন্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলোর বিপক্ষে।
আর এ ব্যবস্থারই অন্যতম স্তম্ভ দানবতুল্য শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দানবের মতো এরা কেটে নিচ্ছে বন, খাবলে তুলছে মাটি, গিলে নিচ্ছে জল, টেনে নিচ্ছে বাতাস, মাটির গভীর থেকে তুলে আনছে সম্পদ। তারপরে, মুনাফার জন্য পণ্য বানিয়ে উচ্ছিষ্ট, আবর্জনা, দূষিত তরল পদার্থ, বিষাক্ত গ্যাস উগড়ে দিচ্ছে, ঢেলে দিচ্ছে, বাতাসের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে। নিজেদের কুর্কীতির কালো দাগ হাত থেকে মুছে ফেলতে, কুৎসিত চেহারা ঢেকে রাখতে ‘সামাজিক দায়বোধের’ যৎসামান্য পয়সা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়ে। সেই পয়সা কুড়িয়ে নিয়ে কতিপয় সমাজ হিতৈষী মেতে উঠছেন পরিবেশ ‘রক্ষায়’। এক চমৎকার পরিবেশ ‘রক্ষা’ উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে। আর প্রতারিত হচ্ছে গরিবরাই।
অথচ পরিবেশ ধ্বংসের এমন আয়োজন আজ পৃথিবীকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, স্টকহোমে চলতি বছরের ১৬-১৯মে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বলা হয়েছে : এই গ্রহ এক নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগে প্রবেশ করেছে। এ যুগের নাম এনথ্রোপোসেন। চলতি পথে চলা আমরা অব্যাহত রাখতে পারি না। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পৃথিবীর টিকে থাকার পথ খুঁজে পেতে বিজ্ঞান আমাদের সাহায্য করবে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, সমাজের কাছে বিজ্ঞানকে খোলাখুলিভাবে নিয়ে যেতে হবে। বলেছেন ১৯৯৫-এ রসায়ন শাস্ত্রে নোবেলজয়ী মারিও মলিনা। সম্মেলনে সুপারিশ করা হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত হচ্ছে টেকসই পরিবেশ। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দিনে ২ডলারের চেয়ে কম অর্থে জীবন কাটায়। তাই, সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। নতুন কৃষি বিপ্লব ঘটাতে হবে যেখানে বর্তমান কৃষি জমিতেই টেকসই পন্থায় খাদ্য উৎপাদন করা হয়। বিজ্ঞান শিক্ষাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে হবে।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো, কোন অর্থনীতি এসব পদক্ষেপ নেবে? কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়াবে এসব পদক্ষেপের পক্ষে? সে কি সেই অর্থনীতি যা আপামর মানুষের কথা বিবেচনা না করে কেবল মুনাফার দিকে নজর রাখে? সে কি সেই অর্থনীতি যা সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশকে বিবেচনা করে পৃথকভাবে? অথচ এ তিনটি মিলেমিশে আছে? সমাজ আর অর্থনীতি তো পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় গোটা সমাজ, পুরো অর্থনীতি ধসে পড়েছে। এমন উদাহরণ ইতিহাসে অনেক।
তাকিয়ে দেখুন, দারিদ্র্যের এই চরাচরে প্রতি রাতে আপনার এই ভুখা ভারত নিদ্রায় ডুব দেয় আধপেটা খেয়ে কিংবা খালি পেটে। শুধু মাত্র এক আঁজলা পানীয় জল আর জোয়ার-বাজরার মোটা রুটি, নিদেনপক্ষে শাক-পাতার অভাবে আজন্মপ্রিয় স্থাবর-অস্থাবর সব কিছু পেছনে ফেলে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় আম-আদমির দল। আর কী অসহ্যঅশ্লীল নীরবতায় নতুন অর্থনীতির হাতে নিষ্ঠুর সব গণহত্যা আর ভিটেছাড়ার ঘটনাবলী অনুল্লেখিত কিংবা অর্ধ-উল্লেখিত হয়ে চাপা পড়ে থাকে এদেশের বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে।