মৌলবাদীদের
কাছে ডারউইনের বিপদ
মোদি
সরকারের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, তিনি চার্লস
ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব মানেন না। কারণ, বাঁদর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের
সৃষ্টির কথা আসলে ‘মিথ’। আমাদের
পূর্বপুরুষেরা কেউ বাঁদরকে মানুষে পরিণত হতে দেখেননি। তাই ওই তত্ত্ব স্কুল-কলেজে পড়ানো
উচিত নয়। সালটা ২০১৮।
সেদিন দেশের
শীর্ষস্থানীয় তিনটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি-নিউ
দিল্লি, ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-বেঙ্গালুরু এবং ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব
সায়েন্সেস-প্রয়াগরাজ) এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল: মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের কোনও
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। বিবর্তনের
তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। এটি এমন একটি তত্ত্ব, যার ভিত্তিতে
এমন বহু অনুমান করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো পরবর্তী কালে সত্য
বলে প্রমাণিত হয়েছে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যকে
অনেকে ব্যক্তিগত অজ্ঞতার বিষয় বলেও ভেবেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা যে তা ছিল না,
মন্ত্রী যে কেন্দ্রে শাসন পরিচালনায় নিযুক্ত একটি গোষ্ঠীর মতকেই
প্রতিধ্বনিত করেছিলেন, তা সিবিএসই’র
ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে নবম দশম
শ্রেণির বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে। কী ভয়ঙ্কর ভাবুন, একাদশ-দ্বাদশে যে সব পড়ুয়া
জীববিজ্ঞান পড়বে না, তাদের আর স্কুলজীবনে ডারউইনের নামই শোনা
হবে না!
কিন্তু
কেন এই পদক্ষেপ? এর মূল কারণ, যে সময়ে বাইবেলের বিরোধিতা আর
দেশদ্রোহিতা সমার্থক, সেইসময় দাঁড়িয়ে চার্লস রবার্ট ডারউইন
যত দেখেছেন, তত লিখেছেন। তাঁর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি ও
বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, এক প্রজাতি
থেকে আর এক প্রজাতির সৃষ্টি একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। সৃষ্টির পিছনে কোনও এক
অজানা-অচেনা, শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ভূমিকাকে পুরোপুরি
নস্যাৎ করে দিয়েছে বিবর্তনবাদ। তিনি এ কথাও খুব স্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন, বাইবেলে বর্ণিত নোয়ার নৌকায় যাদের ঠাঁই মিলেছিল শুধু তারাই পৃথিবীতে টিকে
গিয়েছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনটা নয়। বরং কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে
পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যারা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে, প্রকৃতি শুধু তাদেরই
দিয়েছে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। এর অর্থ একটাই, বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। এই ধরিত্রীর
বুকে টিকে থাকা সহজসাধ্য নয়। এর জন্য লড়াই করতে হয়, নচেৎ
অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। ডারউইন-প্রবর্তিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের এটাই মূল কথা।
ফলে
ধর্মতাত্ত্বিকরা ভীষণ বিপদে পড়ে যান। মজার কথা, গোঁড়া খ্রিস্টানের মতো গোঁড়া মুসলিমরাও
বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন, মানুষের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা
আল্লা। গেরুয়া শিবির যেমন মনে করে, মানুষের সৃষ্টি সরাসরি
মুনি-ঋষিদের ঔরস থেকে। কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের পরে
ধর্মতাত্ত্বিকদের আশ্রয় ছিল জীবজগৎ, বিশেষ করে মানুষের
সৃষ্টি। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়— এই
বিশ্বাসই ছিল তাঁদের শক্তির শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ জীবজগৎ
সৃষ্টির পিছনে প্রাকৃতিক নিয়মের কথা প্রমাণ করে দেওয়ায় তা ধর্মতাত্ত্বিকদের কফিনে
শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল। তাই ডারউইনের জীবদ্দশাতেই তীব্র আক্রমণ শুরু হয়েছিল,
এখনও যা অব্যাহত। ডারউইন তাঁর জীবদ্দশায় ‘থমাস হেনরি হাক্সলি’র মতো
সমর্থক পেয়েছিলেন। লন্ডনের এক বিতর্কসভায় বিশপ উইলবারফোর্স বিদ্রুপ করে হাক্সলিকে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কোন দিক থেকে নিজেকে বানরের
উত্তরাধিকারী মনে করছেন, বাবার দিক থেকে নাকি মায়ের দিক থেকে?
শোনা যায়, হাক্সলির সপাট উত্তর ছিল, নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে সত্য আড়াল করার কাজে ব্যবহার করেন, এমন কোনও
ব্যক্তির চেয়ে একটা বানর তাঁর কাছে পূর্বপুরুষ হিসেবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
বিজ্ঞানের
সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধ অবশ্য নতুন কিছু নয়। ডারউইনের জন্মেরও বহু বছর
আগে আমরা দেখেছিলাম, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই পরম সত্যটি উচ্চারণ করায়
গ্যালিলিওকে চার্চ ও শাসকের কী ভয়ানক কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। নিউটনের তত্ত্ব
ঘিরেও এককালে কম বিতর্ক হয়নি। স্কুলে ডারউইনবাদ পড়ানোর অপরাধে এক শতাব্দী আগে
আমেরিকায় বিজ্ঞান শিক্ষক টমাস স্কোপসকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের অমোঘ
প্রমাণের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে ধর্মকে। তবুও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক
সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘এখন নাকি বিজ্ঞানের
যুগ। তাই প্রায়ই যুক্তি দেওয়া হয়, বিজ্ঞানের যুগের সঙ্গে তাল
মিলিয়ে ধর্মেও পরিবর্তন আনতে হবে। আমি ঠিক উল্টো কথা বলি। যদি বিজ্ঞানের প্রতিটি
গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মে পরিবর্তন করতে হয়, তা হলে ধর্ম আর
ধর্ম থাকবে না।’ ঠিক বলেছিলেন ‘গুরুজি’! আসলে ভাবার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ
ধ্বংস করার প্রয়োজন যখনই পড়ে, তখনই বিজ্ঞানের উপর আক্রমণ হয়।
দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে যতই বিরোধিতা থাকুক, বিজ্ঞানকে
আক্রমণের প্রশ্নে, অন্ধ বিশ্বাসে মদত দেওয়ার প্রশ্নে তাদের
আশ্চর্য মিল। লেবানন, তিউনিশিয়া, সৌদি
আরব, তুরস্ক, জর্ডন সমেত বেশ কিছু
ইসলামিক রাষ্ট্রে ডারউইন পড়ানো নিষিদ্ধ অথবা রাষ্ট্রের দ্বারা সমালোচিত। ভারতের
প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে সিলেবাস থেকে ডারউইনের থিওরি খারিজ করা হয়েছে বহুকাল আগেই।
পাশ্চাত্যের গির্জাতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে ডারউইনের বিরোধ তো সেই গোড়া থেকেই। হিন্দু,
ইসলাম বা খ্রিস্টান— যে কোনও ধর্মের গোঁড়ামিই
বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখতে শেখায়। সেই ধর্মীয় গোঁড়ামি
পুরাণকে ইতিহাস বলে, আর বিবর্তনের তত্ত্ব খারিজ করে দেয়।
আর তাই অন্ধ্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি নাগেশ্বর রাওয়ের মতো কিছু অধ্যাপক দাবি করে বসেন, উনিশ
শতকে বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাখ্যার বহু আগেই হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’য় উল্লিখিত দশাবতারে প্রাণিজগতের বিবর্তন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিষ্ণুর
দশাবতারে বলা সেই বিবর্তন তত্ত্ব, ডারউইনের তত্ত্বের থেকে
অনেকে বেশি উন্নতমানের। ১০৬তম বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাও বলেছিলেন,
দশাবতার শুরু হচ্ছে ‘মৎস্য অবতার’ দিয়ে, জলজ প্রাণী। তারপর ‘কূর্ম
অবতার’, অর্থাৎ কি না উভচর। যে জলেও বাঁচে, ডাঙাতেও। চতুর্থ অবতার ‘নরসিংহ’। অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহ। পঞ্চম অবতার ‘বামন’। আকারে ছোট মানুষ। ...শেষে এলেন রাম। একজন সম্পূর্ণ
মানুষ। তারপর কৃষ্ণ। আরও জ্ঞানী, বিচারক্ষমতা, কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন। শুধু বিবর্তন তত্ত্বেই থামেননি অন্ধ্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। রামায়ণ-মহাভারত সম্পর্কেও নানা দাবি করেছিলেন তিনি।
যেমন— কৌরবদের জন্ম স্টেম সেল থেকে, টেস্টটিউব
প্রযুক্তির মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর আগেই ভারতের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। বিষ্ণুর
হাতের সুদর্শন চক্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে আবার তাঁর হাতে ফিরে আসত। শুধু
পুষ্পক-রথ নয়, রাবণের অন্তত ২৪ ধরনের বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান ছিল...
এইভাবে একদিকে
যেমন কাল্পনিক বিষয় এবং প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত বিষয়কে ‘সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও
ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা হচ্ছে। গত কয়েক বছর এই অতীতের
বিজ্ঞান গৌরবগাথার জয়গান যে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে তার পিছনের কারণটা বোঝা সহজ। এই ‘বিজ্ঞান’ হল বিশুদ্ধ ‘হিন্দু’
বিজ্ঞান যা রামায়ণ-মহাভারত-গীতা-পুরাণে বিস্তৃত। সব কিছুর মূলে
হিন্দুত্ববাদ। ‘হিন্দু সভ্যতা’ হিসেবেই
যে ভারত এক সময় বিশ্বে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, সে কথা প্রমাণ
করার মরিয়া প্রয়াস। বিপদটা এখানেই। বিপদটা অপবিজ্ঞানে। বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহার
করে যুক্তিহীন বিষয় পরিবেশনের চেষ্টা।
আমাদের
পৌরাণিক গল্পগাথাগুলি বেশির ভাগই রূপকাশ্রিত। তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, ইতিহাস আছে। সেটা
ক্ষতিকর নয় যতক্ষণ না তাকে বাস্তব বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু পুষ্পক রথকে বিমান
বা গণেশের মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ ইত্যাদি বলে উপস্থাপন করার অর্থ,
কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই কাল্পনিক ঘটনাকে বিজ্ঞানাশ্রিত বলে বিশ্বাস করানো। বিজ্ঞানের
মূল কথাই হল, কার্যকারণ সম্পর্কের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা। যেকোনও তত্ত্বকে প্রশ্ন
করাই প্রকৃত অনুসন্ধিৎসুর কাজ, এবং চাক্ষুষ প্রমাণ ছাড়া কোনও
কিছুকে বিশ্বাস না করাও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গির আবশ্যিক অঙ্গ। তাই এই ধরনের ধারণা
ছড়ানো মানে বিজ্ঞানচেতনার গোড়ায় আঘাত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি, বিশেষত আরএসএস আসলে তাদের ভাবধারা, হিন্দুত্বের
তত্ত্বে বিশ্বাসী একটি পাকাপাকি ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিজস্ব
ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত করতে চাইছে। এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে চাইছে, যারা তাদের ভাবধারাতেই বড় হয়ে উঠবে। তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েছে
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।
কেউ কি
ভেবে দেখেছেন, এদেশে মোদিরাজও হঠাৎ একদিনে তৈরি হয়নি— এই সরকারও
বিবর্তিতই হয়েছে প্রায় এক দশক ধরে। সেই বিবর্তনে অন্যতম অনুঘটক গরিষ্ঠ সংখ্যক ভারতীয়
নাগরিকের নীরবতা!